দেনমোহর কখন সম্পূর্ণ মাফ হয়ে যায় অথবা কখন অর্ধেক দেয়া যায় কিংবা কখন সম্পূর্ণ দিতে হয়?

আইনগত অধিকার দেনমোহর নারী ও শিশু মানবাধিকার

দেনমোহর: মূলত একটি বৈধ বিবাহে স্বামী তার স্ত্রীকে মর্যাদার প্রতীক হিসাবে যা প্রদান করে তাকেই দেনমোহর বলে। উপমহাদেশেশের বিখ্যাত আইনবিদ D. F. MOLLAH বলেন, “Mahr or dower is a sum of money of the other property which the wife is entitled to receive from the husband in consideration of the marriage.” অর্থাৎ মোহর হল এমন কোন সম্পদ বা অর্থ যা স্ত্রী তার স্বামীর নিকট হতে বিবাহের প্রতিদান হিসাবে পাওয়ার অধিকার রাখে। দেনমোহরের প্রধান সোর্স বা উৎস হল পবিত্র কুরআন। সুরা আন-নিসার ৪ নং আয়াত এ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-

وَءَاتُوا۟ ٱلنِّسَآءَ صَدُقَٰتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَىْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيٓـًٔا مَّرِيٓـًٔا

অর্থঃ আর তোমরা স্ত্রীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে তৃপ্তিসহকারে ভোগ কর।

ইসলামপূর্ব যুগে স্ত্রীর প্রাপ্য মোহর তার হাতে পৌছতো না; মেয়ের অভিভাবকগণই তা আদায় করে আত্মসাৎ করত। যা ছিল নিতান্তই একটা নির্যাতনমূলক রেওয়াজ। এ প্রথা উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে কুরআন নির্দেশ দিয়েছেঃ (وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ) এতে স্বামীর প্রতি নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, স্ত্রীর মোহর তাকেই পরিশোধ কর; অন্যকে নয়। অন্যদিকে অভিভাবকগণকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, মোহর আদায় হলে যার প্রাপ্য তার হাতেই যেন অৰ্পণ করে। তাদের অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ যেন তা খরচ না করে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইহা স্পষ্ট যে, দেনমোহর পরিশোধ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বৈধ বিয়ের পর দেনমোহর দিতেই হবে। স্বামী যদি দেনমোহর প্রদান না করে মারাও যান তবুও স্ত্রী স্বামীর সম্পদ থেকে দেনমোহর আদায় করতে পারেন বা আদায় না হওয়া পর্যন্ত তার অধিকারে রাখতে পারেন। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে যখন স্ত্রীকে কোন দেনমোহর দিতে হয় না কিংবা অর্ধেক দেনমোহর দেয়া যায়।

আইন সংক্রান্ত কোন বিষয় জানতে চাইলে আপনার প্রশ্নটি আমাদেরকে জানান; প্রশ্ন জানাতে এখানে ক্লিক করুন

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ১০ ধারাতে বলা হয়েছে, ”দেনমোহর প্রদান বা পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে কাবিননামা বা বৈবাহিক চুক্তিতে উল্লেখ না থাকলেও স্ত্রী চাহিবামাত্র তা পরিশোধ করতে হবে। এমনকি দেনমোহর ধার্য্য করা না থাকলেও।”

কাবিননামার শর্ত মোতাবেক পরিশোধ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে দেনমোহর দু-ধরণের হয়ে থাকে, যথা-

  1. মুয়াজ্জল (আশু) এবং
  2. মু-অজ্জল (বিলম্বিত)।

মুয়াজ্জল দেনমোহর হলো, যে দেনমোহর নগদে স্ত্রীকে প্রদান করতে হয় বা বিয়ের আগ মুহুর্তে দিতে হয় অর্থ্যাৎ যে দেনমোহর বিয়ের আসরে বা সংসার জীবন চলাকালীন স্ত্রী চাওয়া মাত্র পরিশোধ করিতে হয়। আর মুঅজ্জল দেনমোহর হলো, ধার্য্যকৃত মোহরের যেই অংশটুকু স্বামীর মৃত্যুর পর বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের পর পরিশোধ করিতে হয়।

উল্লেখ্য যে, দেনমোহর অপরিশোধিত অবস্থায় স্ত্রী যদি স্বামীর আগে মারা যায় তাহলে মৃত স্ত্রীলোকের পক্ষে তার উত্তরাধিকারীরা ঐ অপরিশোধিত দেনমোহর পাওয়ার আইনত অধিকারী হবে এবং উক্ত উত্তরাধিকারীরা তৎপ্রেক্ষিতে আদালতে মামলা করতে পারবে। তবে, আদালতে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ১৯০৮ সনের তামাদি আইনের তফসিল-০১ এর অনুচ্ছেদ- ১০৩ ও ১০৪ প্রয়োগ হবে।

অর্থাৎ, মুয়াজ্জল মোহরের ক্ষেত্রে দেনমোহর দিতে অস্বীকৃতির দিন থেকে অথবা মৃত্যু কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের দিন থেকে ০৩ বছরের মধ্যে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে আর মুঅজ্জল মোহরের ক্ষেত্রে মৃত্যু কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের দিন থেকে ০৩ বছরের মধ্যে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। [স্ত্রী লিখিতভাবে তালাক প্রাপ্ত হলে ঐ লিখিত তালাক দানের নোটিশ বা তথ্য বা সংবাদটি অবহিত হওয়ার পর থেকে তামাদির মেয়াদ শুরু হবে।]

এই ব্লগে আপনার নিজের লেখা আর্টিকেল প্রকাশ করতে আমাদেরকে পাঠান; আর্টিকেল পাঠাতে এখানে ক্লিক করুন

 

দেনমোহর সম্পূর্ণ মাপ হয়ে যায় কখন: ইতোমধ্যে এই বিষয় সম্পূর্ণ অবগত হয়েছি যে দেনমোহর কখনো সম্পূর্ণ মাপ হয়ে যায় না। মহামান্য উচ্চ আদালতের এরূপ একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে, দেনমোহর কখনোই মাপ পাওয়া যায় না। স্বামী যদি মারাও যায় তবে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে দেনমোহর আদায় করা যাবে। (২২ ডিএলআর, পৃষ্ঠা- ৬৭৭)। তবে সুরা আন-নিসার ৪ নং আয়াত এর ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, যদি স্ত্রী খুশি হয়ে কিছু মাফ করে দেয় তাহলেই কেবলমাত্র দেনমোহর মাফ হতে পারে। তবে এরূপ মাফ করে দেয়ার পরেও স্ত্রী পুনরায় দেনমোহর দাবি করতে পারে। খলীফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এমন একটি ঘটনার ব্যাপারে রায় দিতে গিয়ে বলেন যে, যদি স্ত্রী সত্যিই তার মোহর মাফ করে দিতেন তাহলে তিনি তা পুনরায় চাইতেন না। স্ত্রী মাফ করার পর পুনরায় মোহর চাওয়ার অর্থ তিনি প্রথমে প্রকৃত অর্থে তার মোহরের দাবি ত্যাগ করেননি। (Doi, Abdur Rahman; Shariah: The Islamic Law, 1997, Ta Ha Publishers, London, UK,159)

দেনমোহর কখন অর্ধেক দেয়া যায়: সুরা আল-বাকারার ২৩৭ নং আয়াত এ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-

وَ اِنۡ طَلَّقۡتُمُوۡہُنَّ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ تَمَسُّوۡہُنَّ وَ قَدۡ فَرَضۡتُمۡ لَہُنَّ فَرِیۡضَۃً فَنِصۡفُ مَا فَرَضۡتُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ یَّعۡفُوۡنَ اَوۡ یَعۡفُوَا الَّذِیۡ بِیَدِہٖ عُقۡدَۃُ النِّکَاحِ ؕ وَ اَنۡ تَعۡفُوۡۤا اَقۡرَبُ لِلتَّقۡوٰی ؕ وَ لَا تَنۡسَوُا الۡفَضۡلَ بَیۡنَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ

অর্থঃ আর তোমরা যদি তাদেরকে স্পর্শ করার আগে তালাক দাও, অথচ তাদের জন্য মোহর ধার্য করে থাক, তাহলে যা তোমরা ধার্য করেছ তার অর্ধেক, তবে যা স্ত্রীগণ অথবা যার হাতে বিয়ের বন্ধন রয়েছে সে মাফ করে দেয় এবং মাফ করে দেয়াই তাকওয়ার নিকটতর। আর তোমরা নিজেদের মধ্যে অনুগ্রহের কথা ভুলে যেও না। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ তা সবিশেষ প্রত্যক্ষকারী।

দেনমোহর অর্ধেক দেয়ার বিষয়ে Taibi vs Nathai Sharif (1940) 2 MLJ 345 = 191IC728 এই মামলায়ও আদালত বলেন- If the marriage was not consummated and the amount of dower was specified in the contract she is entitled to half of the amount.

সুতরাং এখানে এটা স্পষ্ট যে, যদি বৈধ বিবাহ হয় এবং দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় কিন্তু যদি স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক কিংবা দাম্পত্য নির্জনতা পালন না হয় সেক্ষেত্রে অর্ধেক দেনমোহর দেয়া যাবে। আর যদি স্ত্রী তা ক্ষমা করে দেয় কিংবা স্বামী পুরো মোহর দিয়ে দেয়, তবে তা হচ্ছে তাদের ঐচ্ছিক ব্যাপার।

আলোচকঃ
মো. এস এইচ সোহাগ,
আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা।
বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *