ভিন্ন ধর্মে বিবাহ বলতে বুঝায় বিবাহের পাত্র একটি ধর্মাবলম্বী এবং পাত্রী অপর একটি ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ উভয় একই ধর্মাবলম্বী নয়। এই আর্টিকেলের আলোচনার বিষয় হলো- ভিন্ন ধর্মে বিবাহ আইনত বৈধ কিনা আর বৈধ হলে ভিন্ন ধর্মে বিবাহের নিয়ম কি? এক্ষেত্রে Special Marriage Act (বিশেষ বিবাহ আইন) কি বলে? এসকল বিষয় সম্পর্কে বুঝতে সর্বপ্রথম জানতে হবে বিবাহের সংজ্ঞা কি এবং বিভিন্ন ধর্মে বিবাহরীতি কেমন?
বিবাহ: বিবাহযোগ্য একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি হলো বিবাহ। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত রয়েছে। যেমন-
ইসলামী বিবাহরীতিঃ ইসলামী বিবাহরীতিতে পাত্র পাত্রী উভয়ের সম্মতি এবং বিবাহের সময় উভয়পক্ষের বৈধ অভিভাবক বা ওয়ালীর উপস্থিতি ও সম্মতির প্রয়োজন। ইসলামী বিবাহে যৌতুকের কোন স্থান নেই তবে বিয়ের পূর্বেই পাত্রীর দাবি অনুযায়ী পাত্রের পক্ষ হতে পাত্রীকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বা অর্থসম্পদ বাধ্যতামূলক ও আবশ্যিকভাবে দিতে হয়, একে দেনমোহর বলা হয়। [দেনমোহর কখন মাফ হয়ে যায় আর কখন অর্ধেক দেয়া যায় সে সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন] ইসলামে একজন মুসলিম একজন অমুসলিমকে বিয়ে করতে পারবে যদি উক্ত অমুসলিম ঈমান আনে অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
এভাবে প্রতিটি ধর্মের বিবাহরীতিতে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম-কানুন রয়েছে। সুতরাং যে যে ধর্মে বিশ্বাসী সে সেই ধর্মের রীতিনীতি অনুসরণ করেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। এখানে একটি জটিলতা থেকে যায় সেটা হলো- যে ব্যক্তি কোন ধর্মে বিশ্বাসী নয় (নাস্তিক-Atheist) সে ব্যক্তি কোন্ ধর্মের রীতিনীতি অনুসরণ করে বিয়ে করবেন? আর সেই জটিলতা সমাধানের জন্যই ১৮৭২ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয় “
The Special Marriage Act, 1872” নামে। আমরা জানি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দুজন মানুষ নিজেদের ধর্ম ঠিক রেখে বিবাহ করতে চাইলে তাদেরকে The Special Marriage Act, 1872 অনুযায়ী বিবাহ করতে হয়। আমাদের জানা এই তথ্যটি সম্পূর্ণরূপে সঠিক নয়।
আইন সংক্রান্ত কোন বিষয় জানতে চাইলে আপনার প্রশ্নটি আমাদেরকে জানান; প্রশ্ন জানাতে এখানে ক্লিক করুন
The Special Marriage Act, 1872 এর প্রস্তাবনা এবং সংজ্ঞা (ধারা-২) বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- যে সকল ব্যক্তি নাস্তিক (Atheist) তারা কোন ধর্মীয় বিবাহরীতি ছাড়াই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে এবং যে সকল ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মাবলম্বী তারা নিজেদের ধর্ম ঠিক রেখে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। অর্থাৎ শুধুমাত্র এই ০৪ (চার) ধর্মাবলম্বীরাই নিজেদের ধর্ম ঠিক রেখে বিবাহ করতে চাইলে The Special Marriage Act, 1872 অনুযায়ী বিবাহ করতে পারবে। এই ০৪ (চার) ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কাউকে বিয়ে করতে চাইলে নিজেদেরকে নাস্তিক (Atheist) ঘোষণা দিয়েই এই আইনে বিবাহ করতে পারবে।
Preamble: WHEREAS it is expedient to provide a form of marriage for persons who do not profess the Christian, Jewish, Hindu, Muslim, Parsi, Buddhist, Sikh or Jaina religion, and for persons who profess the Hindu, Buddhist, Sikh or Jaina religion and to legalize certain marriages the validity of which is doubtful.
অর্থ- ঐ সকল ব্যক্তিগণের জন্য একটি বিবাহ পদ্ধতি তৈরি করা যারা খ্রিষ্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলিম, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী নন এবং যারা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী এবং ঐ সকল বিবাহকে আইন অনুযায়ী বৈধতা প্রদান করা যে বিবাহের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ আছে।
আবার মুসলিম শরীয়াহ অনুযায়ী একজন মুসলিম পুরুষ নিজ ধর্মের বাহিরেও বিবাহ করতে পারে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র কিতাবিয়া নারী অর্থাৎ যাহাদের নিকট আসমানি কিতাব রয়েছে; যেমন- ইহুদি, খ্রিষ্টান।
সূরা আল-মায়িদাহ এর ৫ নং আয়াত এ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-
“… মুমিন সতীসাধ্বী নারী ও আহলে কিতাবের সতীসাধ্বী নারী তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো…।”
অপরদিকে মুসলিম শরীয়াহ অনুযায়ী একজন মুসলিম নারী কখনোই নিজ ধর্মের বাহিরে অন্য কোন পুরুষকে বিবাহ করতে পারবেন না।
সূরা আল-বাকারা এর ২২১ নং আয়াত এ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-
“… ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা মুশরিক পুরুষের সঙ্গে (তোমাদের নারীদের) বিয়ে দিয়ো না, যদিও মুশরিক পুরুষ তোমাদের মুগ্ধ করে…।”
আবার ১৯৪৮ সালের
মানবাধিকার সনদ (Universal Declaration of Human Rights – UDHR) এর আর্টিকেল ১৬ তে উল্লেখ আছে- “Men and women of full age, without any limitation due to race, nationality or religion, have the right to marry and to found a family. They are entitled to equal rights as to marriage, during marriage and at its dissolution.” অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের পারস্পারিক সম্মতিতে বিবাহ করার বা বিবাহ বিচ্ছেদ করার এবং পরিবার গঠনের অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে গোত্র, জাতীয়তা বা ধর্ম কোন কিছুই বাধা হবে না।
সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে- মুসলিম শরীয়াহ অনুযায়ী একজন মুসলিম পুরুষ নিজের ধর্ম ঠিক রেখে কখনোই অন্য কোন ধর্মাবলম্বী (আহলে কিতাবের নারী ব্যতীত; এক্ষেত্রে অবশ্যই আহলে কিতাবের নারী সতীসাধ্বী হতে হবে। ইসলাম বিদ্বেষী হতে পারবে না) নারীকে বিবাহ করতে পারবে না এবং একজন মুসলিম নারী কখনোই অন্য কোন ধর্মাবলম্বী পুরুষের সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না।
আর The Special Marriage Act, 1872 এর বিধান অনুযায়ী কোন মুসলিম নর-নারী নিজের ধর্ম ঠিক রেখে কখনোই অন্য কোন ধর্মাবলম্বীর নর-নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না; এরূপ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হলে নিজেকে নাস্তিক (Atheist) ঘোষণা করতে হবে।
এই ব্লগে আপনার নিজের লেখা আর্টিকেল প্রকাশ করতে আমাদেরকে পাঠান; আর্টিকেল পাঠাতে এখানে ক্লিক করুন
The Special Marriage Act, 1872 এর ধারা ২ এর বিধান অনুযায়ী বিশেষ বিবাহের জন্য প্রদত্ত শর্ত সমূহঃ-
- বিবাহের সময় কোন পক্ষের স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না।
- বিবাহের সময় বরের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর এবং কনের বয়স ন্যূনতম ১৪ বছর হতে হবে।
- বিবাহের সময় কোন পক্ষের বয়স যদি ২১ বছরের কম হয় তাহলে তার পিতার অথবা অভিভাবকের সম্মতি লাগবে।
ধারা ৪ এর বিধান অনুযায়ী- বিবাহ সম্পাদনের ১৪ দিন আগে যেকোনো এক পক্ষকে নিবন্ধকের মাধ্যমে অপর পক্ষের কাছে বিবাহের জন্য লিখিত নোটিশ পাঠাতে হবে।
ধারা ১০ এর বিধান অনুযায়ী- নিবন্ধকের উপস্থিতিতে পক্ষদ্বয় এবং ০৩ (তিন) জন সাক্ষীকে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে এই আইনের দ্বিতীয় তফসিলে থাকা নির্ধারিত ফরমে একটি ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করতে হবে। এক্ষেত্রে কোন পক্ষের বয়স যদি ২১ বছরের কম হয় তাহলে তার পিতাকে অথবা অভিভাবককে উক্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে।
ধারা ১১ এর বিধান অনুযায়ী- বিবাহ সম্পাদন করতে হবে নিবন্ধক এবং ০৩ (তিন) জন সাক্ষীর সম্মুখে এবং পক্ষদ্বয়কে নিবন্ধক এবং সাক্ষীদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে হবে, “I [A], take the [B], to be my lawful wife (or husband).”
ধারা ১৫ এর বিধান অনুযায়ী- কোন পক্ষ যদি বিবাহিত থাকা অবস্থায় বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে উক্ত পক্ষ দণ্ডবিধির ৪৯৪ এবং ৪৯৫ ধারার অপরাধে অপরাধী হবে এবং পরবর্তী বিবাহটি বাতিল (Void) বলে গণ্য হবে।
বিবাহ বিচ্ছেদ
ধারা ১৭ এর বিধান অনুযায়ী- The Special Marriage Act, 1872 বিবাহিত দম্পতির কাউকে বিবাহ বিচ্ছেদের কোনরূপ ক্ষমতা দেয় না। এরূপ ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু জটিলতা। এক্ষেত্রে অবশ্যই
The Divorce Act, 1869 অনুসরণ করতে হবে। এই আইনের ধারা ১০ এর বিধান অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইলে কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে এবং এক্ষেত্রে আদালতে আবেদন করতে হবে; কোন নিবন্ধকের কার্যালয় কিংবা কোন নোটারী পাবলিকের কার্যালয় থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর কোন সুযোগ এখানে নাই।
উত্তরাধিকার
ধারা ২৪ এর বিধান অনুযায়ী- হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী এবং দাবিকৃত দম্পতির সন্তানদের সম্পত্তি
The Succession Act, 1925 এর বিধান অনুসরণ করে বন্টিত হবে।
দত্তক গ্রহণ
ধারা ২৫ এর বিধান অনুযায়ী- The Special Marriage Act, 1872 হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী এবং দাবিকৃত দম্পতিকে দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে। তবে ধারা ২৬ এর বিধান অনুযায়ী এরূপ দম্পতির যে কারো পিতার যদি অন্য কোন পুত্র সন্তান না থাকে তাহলে তিনি কোন পুত্র সন্তানকে দত্তক গ্রহণ করতে পারবেন।
হলফনামা
The Special Marriage Act, 1872 অনুযায়ী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হলে হলফনামা প্রয়োজন এমন কোন নির্দেশনা বা তথ্য এই আইনে নাই। তবে যেহেতু শুধুমাত্র ০৪ (চার) ধর্মাবলম্বীরাই (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন) নিজেদের ধর্ম ঠিক রেখে বিবাহ করতে পারবে সেহেতু উক্ত ঘোষণা সংক্রান্ত হলফনামা সম্পাদন করা যেতে পারে। আবার যেহেতু এই ০৪ (চার) ধর্মাবলম্বী ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কাউকে বিয়ে করতে চাইলে নিজেদেরকে নাস্তিক (Atheist) ঘোষণা দিয়েই এই আইনে বিবাহ করতে হবে সেহেতু উক্ত ঘোষণার জন্য অবশ্যই প্রত্যেককে পৃথক পৃথক হলফনামা সম্পাদন করতে হবে।
আলোচকঃ
মো. এস এইচ সোহাগ,
আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা।